বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:০৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বৈশ্বিক গণমাধ্যমে পরিবর্তিত বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমি

ড. প্রণব কুমার পান্ডে:

বিএনপি যখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে ব্যস্ত রয়েছে, ঠিক সেই সময় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত কয়েকটি রিপোর্ট দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ও দ্য টেলিগ্রাফের একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবর্তিত পটভূমি সম্পর্কে আলোকপাত করেছে।

তিনটি রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত সরকারের অবস্থান যা সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অস্পষ্ট ছিল। তবে প্রতিবেদনগুলোতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভূ-রাজনৈতিক বিষয় এবং ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। আনন্দবাজার এবং ডয়চে ভেলেতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, নয়াদিল্লি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হলে তা ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য সহায়ক হবে না। কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, নয়াদিল্লি একাধিক স্তরের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন সরকারের যে হস্তক্ষেপ সেটি সম্পর্কে ভারতের কিছুটা হলেও আপত্তি রয়েছে। যদিও ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে। তবে নয়াদিল্লি বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা গৃহীত কিছু পদক্ষেপ শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্বল করতে পারে, যা ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি হতে পারে।

দ্য টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি পৃথক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। প্রথমত, উভয় দেশই বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণাকে সমর্থন করে এবং দ্বিতীয়ত, তারা চীনপন্থি এবং ইসলামপন্থি নেতাদের বাদ দিয়ে দলে অসাম্প্রদায়িক এবং জনপ্রিয় প্রার্থীদের গুরুত্ব প্রদানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে আহ্বান জানাবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, উভয় দেশই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করতে চায় না।

ফলে এসব তথ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলো এ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য আপাতদৃষ্টিতে সুবিধাজনক বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত সরকার যদি বাংলাদেশি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপন্থি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তা হবে উদ্বেগের বিষয়। তিনি এ ধরনের হস্তক্ষেপকে দুর্ভাগ্যজনক এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে লঙ্ঘন বলে মনে করেন। অন্যদিকে, মির্জা ফখরুল এবং তার দল বাংলাদেশের জন্য কার্যকর করা মার্কিন ভিসা নীতির প্রশংসা করেছেন, যা ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

জঙ্গিবাদের প্রতি সরকারের জিরো টলারেন্স প্রদর্শন এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয় পদক্ষেপ ভারতের প্রশংসা অর্জন করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নাজুক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কার্যকরভাবে জঙ্গিবাদ দমন এবং বাংলাদেশের মাটিকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে না দিয়ে, শেখ হাসিনার সরকার ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে অবদান রেখেছে। এই সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু উভয় দেশকে সরাসরি উপকৃত করেনি, বরং বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় প্রেক্ষাপটে আস্থা ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতেও অবদান রেখেছে।

অন্যদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি শাসনামলের তিক্ত অতীতের স্মৃতি এখনো ভারত সরকারের চেতনায় রয়ে গেছে, যা তাদের বাংলাদেশে বিএনপি সরকারের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করার বিষয়ে সতর্ক করে তুলেছে। এই সময়কালে ভারত ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দুর্ভাগ্যজনক ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছে, যা তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অশান্তি সৃষ্টিতে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছিল। ফলে এই বিষয়গুলো নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ও অনুষঙ্গের সংমিশ্রণ আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার প্রতি বিএনপির প্রতিশ্রুতি নিয়ে ভারতের মনে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ফলে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বিএনপি সরকারের সঙ্গে জড়িত সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশে এ ধরনের প্রশাসনকে স্বাগত জানানো ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কাম্য না হলেও খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ধরনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থানকে নির্দেশ করে। কারণ এর আগে পরাশক্তিগুলোকে বাংলাদেশকে নিয়ে এত শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে সরকার, বিরোধী দল এবং বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিদের হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করে জাতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে সেটাই দেখার বিষয়।

বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো যদি সত্য হয়, তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি যৌথ অঙ্গীকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব, ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন ধরনের আলোচনা থাকলেও, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের জিরো টলারেন্সের অবস্থান এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তাদের প্রচেষ্টা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচকভাবে অনুরণিত হচ্ছে, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন আদায় করার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকেই সাহায্য করবে। শেষ পর্যন্ত আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জয়ের পাল্লাকেই তা ভারী করবে।

লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ভয়েস/আআ/দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION